নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ নদীবেষ্টিত দক্ষিণাঞ্চলে বরিশাল বিভাগের চিত্র পাল্টে দিতে যাচ্ছে দুই সেতু। এরইমধ্যে সেতু দু’টির নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের লেবুখালী পয়েন্টে পায়রা নদীর ওপর সেতুটির কাজ অনেকটাই শেষ পর্যায়ে। ফলে সেতুটি এখন পুরোপুরি দৃশ্যমানই বলা চলে। আর পিরোজপুরে কচা নদীর ওপর বেকুটিয়া পয়েন্টে অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর পানির নিচের কাজ শেষ হয়ে উপরিভাগের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, পদ্মা সেতু হলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সেই সঙ্গে পিছিয়ে পড়া ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে। পাশাপাশি বেকুটিয়া ও লেবুখালীর সেতু দু’টি বিভাগের অভ্যন্তরীণ মহাসড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনবে। লেবুখালি সেতু চালু হলে বরিশাল ও ঝালকাঠির সঙ্গে সড়কপথে সরাসরি পটুয়াখালী ও বরগুনার জেলার আমতলীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে। স্বল্প সময়ে সড়কপথে সরাসরি পায়রা বন্দরসহ পর্যটনকেন্দ্র সাগরকন্যা কুয়াকাটায় যাতায়াত করাও সম্ভব হবে। এদিকে বেকুটিয়া সেতু চালু হলে পিরোজপুর ও বরগুনার পাথরঘাটার সঙ্গে ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী জেলার সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যোগাযোগ স্থাপন হবে। খুলনার সঙ্গে বাগেরহাট হয়ে সরাসরি বরিশাল-পটুয়াখালীর সড়কপথে যাতায়াত ব্যবস্থাও চালু হচ্ছে। ব্যবসায়ী আরিফুর রহমান বলেন, ‘এ দুই সেতু শুধু বিভাগের পাঁচ জেলার মধ্যেই নয়, আলাদা দু’টি বিভাগ ও দুই বন্দরের (পায়রা ও মোংলা) সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করবে। এতে করে পিছিয়ে পড়া এ জনপদের অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। পাশাপাশি পদ্মাসেতু চালু হলে ঢাকা ও খুলনা থেকে সরাসরি সড়কপথেই নির্বিঘ্নে কম সময়ে পায়রা বন্দর, সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, বরগুনার পাথরঘাটা সংলগ্ন সুন্দরবন পর্যন্ত যাওয়া যাবে। এতে করে কুয়াকাটায় পর্যটনের বিকাশ যেমন ঘটবে তেমনই ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে গোটা বরিশালে।’ অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বিগত সময়ে বরিশাল বিভাগে তেমন কোনো উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়নি। তবে বর্তমান সরকারের আমলে বড় বড় প্রকল্পের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং হচ্ছে। পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, শেখ হাসিনা সেনানিবাস স্থাপন, বিমানবাহিনীর রাডার স্টেশন স্থাপন, প্রকৌশল কলেজ, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দর, পদ্মা সেতু নির্মাণের পাশাপাশি সড়কপথের উন্নয়নে ছোট-বড় বহু সেতু এ অঞ্চলে নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সেতু, শেখ জামাল, শেখ কামাল ও শেখ রাসেল সেতু, পায়রা সেতু, বরিশাল-পিরোজপুর মহাসড়কের কচা নদীর ওপর বেকুটিয়া সেতু উল্লেখযোগ্য।’ এ সবকিছু মিলিয়ে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে একসময়ের অবহেলিত জনপদ দক্ষিণাঞ্চলে। উন্নয়ন মহাযজ্ঞে এরইমধ্যে জমিজমার দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। পায়রা বন্দর ঘিরে ওই এলাকায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেড়েছে। পাল্টে যাচ্ছে এ অঞ্চলের চেহারা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরেই বরিশাল দেশের অন্যতম শিল্পবাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হবে বলে আশা ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিকদের। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাহাউদ্দিন গোলাপ বলেন, পদ্মা সেতুর পাশাপাশি লেবুখালী ও বেকুটিয়া সেতু দক্ষিণাঞ্চলের সব উন্নয়নকে সংযুক্ত করার কাজ করবে। লেবুখালী ও বেকুটিয়া সেতু যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে। এ সেতু দু’টি স্থানীয় অর্থনীতির ওপর যেমন ব্যাপক প্রভাব ফেলবে, তেমনই আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ নাগরিক সুবিধাগুলোও ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। উল্লেখ্য, পায়রা নদীর ওপর লেবুখালীতে ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা সেতুর ভিত্তি উদ্বোধন করেন। ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সেতু নির্মাণের কার্যাদেশ দেয় সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়। এ সময় সেতুর প্রাক্কলন ছিল ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। পরবর্তীকালে যার ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। প্রথম কার্যাদেশের মেয়াদ ছিল ৩৩ মাস। এরপর দুই দফায় সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। জানা গেছে, ৮৪০ মিটার ভায়াডাক্ট এবং ৬৩০ মিটার মূল সেতুসহ পায়রা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৭০ মিটার এবং প্রস্থ ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার। নদীর উত্তর প্রান্তে ৬১০ মিটার এবং দক্ষিণে ৬৫৮ মিটারসহ দুই পাশে মোট অ্যাপ্রোচ সড়ক ১ হাজার ২৬৮ মিটার। এছাড়া, সেতুটি নদীর পানির উচ্চতা থেকে ১৮ দশমিক ৩০ মিটার উঁচু হবে। পায়রা সেতু প্রকল্প ব্যবস্থাপক আহমেদ শরীফ সজিব বলেন, পর্যটনের কথা বিবেচনায় রেখে পায়রা সেতু নির্মিত হচ্ছে চট্টগ্রামের শাহ্ আমানত সেতুর আদলে এক্সট্রাডোজ ক্যাবল স্টেট পদ্ধতিতে নান্দনিক নকশায়। সৌরবিদ্যুতের আলোয় রাতে নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণা হবে পায়রা সেতুতে। অপরদিকে, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিরোজপুরে কচা নদীর ওপর বেকুটিয়া পয়েন্টে অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। ২০২২ সালের মধ্যে কাজের শতভাগ শেষ হওয়ার আশা করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ৯৯৮ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৩ দশমিক ৪০ মিটার প্রস্থের সেতুটি ৮২১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে।
Leave a Reply